শ্রীচৈতন্যের জীবনী রচনা কৃষ্মদাসের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই 'চৈতন্যচরিতামৃত' সুবৃহৎ জীবনীকাব্যে চৈতন্যের অধ্যাত্ম আদর্শকেই যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন।
কৃষ্ণদাস কবিরাজ
চৈতন্যচরিত সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং কৃষ্ণদাসের কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ কর
শ্রীচৈতন্যের জীবনী রচনা কৃষ্মদাসের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই 'চৈতন্যচরিতামৃত' সুবৃহৎ জীবনীকাব্যে চৈতন্যের অধ্যাত্ম আদর্শকেই যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনী ও দর্শনের যুগপৎ সমন্বয়ে 'চৈতন্যচরিতামৃত' অপরূপ গ্রন্থ হয়ে উঠেছে এবং ভক্ত, তাত্ত্বিক ও ভাবুকদের কাছে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
চৈতন্যচরিত সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ।‘চৈতন্যচরিতামৃত' কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্যের নাম। বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকটবর্তী ঝামাটপুর গ্রামে তার নিবাস। পিতার নাম ভগীরথ, মাতা সুনন্দা দেবী। কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিত্যানন্দের শিষ্য ছিলেন ।কবির জন্মকাল ও গ্রন্থরচনার কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে জন্মকাল ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে, জগদ্বন্ধু ভদ্রের মতে ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে।কৃদাসের কাব্যের রচনাকাল নিয়ে ও মত দ্বিধা বিভাক্ত সুকুমার সেনের মতে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের বেশ কিছুকাল আগে। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫৩৪ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে।
মোট তিনটি খণ্ডে বিভক্ত চৈতন্যচরিতামৃত আদি, মধ্য ও অন্ত।কৃষ্মদাসের কাব্যের গঠন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হয় :কবি খণ্ডের পরিবর্তে 'লীলা' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কাব্যের তিনটি লীলা। (ক) আদিলীলা- ১৭টি পরিচ্ছেদের প্রথম ৯টিতে বৈশ্ববতত্ত্ব। বাকি পরিচ্ছেদে জন্ম থেকে সন্ন্যাস বর্ণিত। (খ) মধ্যলীলা—২৫টি পরিচ্ছেদে সন্ন্যাসগ্রহণ, নীলাচলে আগমন, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ, রামানন্দের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা, পুরীতে রথযাত্রায় নৃত্য ইত্যাদি বর্ণিত। (গ) অন্তলীলা—দিব্যোন্মাদ অবস্থা, সমুদ্রে পতন ও উদ্ধার ইত্যাদি বর্ণিত।
কৃষ্ণদাসের কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করঃ-
কৃষ্ণদাসের কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ বলতে গিয়ে বলতে হয়- (ক) তত্ত্বভাবনায় উজ্জ্বল। রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, অচিন্ত্য ভেদাভেদ তত্ত্ব ইত্যাদি বর্ণিত। (খ) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একমাত্র পাঠনীয় গ্রন্থ। (গ) 'যুক্তি-পরম্পরা ও মনস্তত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে। দার্শনিকতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত। (বিমানবিহারী মজুমদার : চৈতন্যচরিতের উপাদান)।
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে কৃষ্ণদাসের উদ্দেশ্য ছিল মহাপ্রভুর জীবনকে অবলম্বন করে অত্যন্ত ভক্তি ও আন্তরিকতা সহকারে তাঁর জীবনের পবিত্রতম আদর্শ প্রচার করা।কৃষ্মদাস কবিরাজ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কৃতবিদ্য কবি। বৈশ্ববীয় ধর্মাদর্শে দীক্ষিত হয়েও তিনি নীরস তত্ত্বদর্শনকে কবিতার রসাশ্রিত করে তুলেছেন। তাঁর কাব্যে গীতিমূর্ছনা না থাকলেও দুরূহ জটিল তত্ত্বকথা একান্ত সরল সহজ ও ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণদাসের কাব্য বৈশ্বৰ দৰ্শনকে উপলব্ধি করার দর্পণ স্বরূপ। তাঁর কবিত্বশক্তির গুণে পরিমিত বাক্যবিন্যাস, ভক্তিতন্ময়তা ও অলংকারের সমন্বয়ে চৈতন্যচরিতামৃত দর্শন ও কাব্যের যুক্তবেণি রচনা করেছে।
অপ্রকট অন্তরঙ্গ-লীলার প্রত্যক্ষ প্রকটনই কৃাদাস কবিরাজের গ্রন্থরচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। বৃন্দাবনবাসী মহাজনগণের নির্দেশে, তাঁদেরই আকুতি চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষায়, কৃষ্ণদাস চৈতন্যজীবন রচনায় লেখনী ধারণ করেছিলেন।কৃষ্মদাস কবিরাজের লেখা দুটি সংস্কৃত কাব্য পাওয়া গিয়েছে। একটি কৃষ্মকর্ণামৃতের টীকা 'সারফারজানা এবং অপরটি 'গোবিন্দলীলামৃত' মহাকাব্য।
চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের আদিলীলা পর্বটি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে কেন ?
চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের আদিলীলা পর্বটি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেকারণ,—(ক) এই পর্বে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় বৃন্দাবনের গোস্বামী সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় বৈশ্ববধর্ম- দর্শন ও রসতত্ত্ব বিশ্লেষিত, বিবৃত ও আলোচিত। (খ) জীব-উদ্ধারের জন্য চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা—বৃন্দাবন দাসের মতো এই তত্ত্ব স্বীকার করেও কৃষ্ণদাস রাধাকৃষ্ণের যুগলতনুরূপে চৈতন্যাবির্ভাবের তত্ত্বটির প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। (গ) চৈতন্যদেব ও তাঁর বিভিন্ন ভক্তদের শাখা নির্ণয় এবং পরিচয় দিয়ে তিনি বৈশ্বধর্ম ও সমাজের ক্রমবিকাশের স্তর পরম্পরা দেখিয়েছেন।
চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের মধ্যলীলার কোন পরিচ্ছেদ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কেন ?
মধ্যলীলার অষ্টম পরিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তথা মূল্যবান। কারণ, আলোচ্যাংশে গৌড়ীয় বৈশ্বব ধর্মের রসতত্ত্ব ও রসপর্যায়ের সুবিস্তৃত আলোচনা স্থান পেয়েছে। রসতত্ত্বের আলোচনা ও তার সুনিবিড় আস্বাদনের পুলকানুভূতি কৃন্মদাসের মননশক্তি ও দার্শনিকতার প্রামাণ্য দলিল।
চৈতন্যভাগবত' ও 'চৈতন্যচরিতামৃত' জীবনী কাব্যদ্বয়ের সংক্ষিপ্তাকারে তুলনামূলক বিচার কর
চৈতন্য জীবনীকাব্য ধারায় এবং চৈতন্যের পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশে গ্রন্থদুটি একে অপরের পরিপূরক। একটিতে মুখ্যত চৈতন্যের প্রথম ২৪ বছরের জীবন, অন্যটিতে পরবর্তী প্রায় ২৪ বছরের জীবন। একটি নবদ্বীপ লীলা, অন্যটিতে বৃন্দাবন লীলা। একটিতে চৈতন্যের একান্ত ঘরোয়া রূপ, অন্যটিতে চৈতন্যের সর্বভারতীয় রূপ। অর্থাৎ যে বৃন্দাবন দাসে নিমাই জন্মাচ্ছে, সেই নিমাই-ই কৃন্মদাসের কাব্যে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য রূপ ধারণ করছে। একটি তথ্য প্রধান, অন্যটি তত্ত্ব প্রধান।.
কৃষ্মদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যজীবনীকাব্য সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
কৃষ্মদাস কবিরাজের 'চৈতন্যচরিতামৃত' বাংলা সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। গৌড়ীয় বৈশ্ববদের বিবিধ তত্ত্ব ও সাধনঘটিত বিশ্বাস এই বইয়ে বিশ্লেষিত। ছন্দোবদ্ধ ভাষায় এইসব জটিল দার্শনিক বিষয়ের ব্যাখ্যা করেছেন কবি। তিনি বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দৃষ্টিতে চৈতন্যকে 'রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত' কৃষ্ণ বলে মনে করেছেন।
কৃষ্মদাস কবিরাজের অলৌকিক ঘটনা বর্ণনার প্রতি ঝোঁক অভ্যস্ত বেশি'—আলোচনা করো ৷
চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের আদিলীলায় আভক্ষণলীলা, মধ্যলীলায় বৌদ্ধ পণ্ডিতের মাথা কাটা যাওয়া ও পুনরুজ্জীবন, কাশী মিশ্র ও প্রতাপ রুদ্রকে চতুর্ভুজ মূর্তি বা ঐশ্বর্য দেখানো, অন্তলীলীয়- ভাবাবেশে শ্রীচেতন্যের এক একখানি পত্র দেড় গজ দীর্ঘ হওয়া, তিন দ্বারে কপাট লাগানো থাকা সত্ত্বেও প্রভুর বার হয়ে যাওয়া প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনা বর্ণিত।
'চৈতন্যচরিতামৃত' ভক্তিসাধনার জীবনবেদ — আলোচনা করো।
ভাবুক বৈশ্ববের দৃষ্টিতে চৈতন্যচরিতামৃত ভক্তিসাধনার জীবনবেদ'। চৈতন্য-জীবনরসের তথ্যাতীত সত্যস্বরূপ তাতে ভাম্বর; কৃদাসও দার্শনিকের দৃষ্টি নিয়ে শ্রীচৈতন্যের এমন অনেক লীলালিখেছেন, যা অপ্রকট লীলায় সত্য। এইভাবেই বৈশ্ববাণ এতাবৎকাল চৈতন্যচরিতামৃতকে আস্বাদ করে আসছেন।
COMMENTS